হাজারো প্রাণের উচ্ছ্বাসে শেষ হলো বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা
বাংলা নববর্ষ, বাঙালির প্রাণের উৎসব, প্রতি বছর ১লা বৈশাখে উদযাপিত হয়। এই দিনটি শুধুমাত্র নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে এই শোভাযাত্রা বর্ণিল রূপ নেয়, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রার ইতিহাস
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো এই শোভাযাত্রা আয়োজন করে। এটি মূলত মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০২৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে “বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা” রাখা হয়, যা আরও ব্যাপকতা ও অন্তর্ভুক্তির প্রতীক।
২০২৫ সালের শোভাযাত্রার বিশেষত্ব
এই বছরের শোভাযাত্রা ছিল আরও বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। এতে অংশ নেয় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং দেশি-বিদেশি অতিথিরা। শোভাযাত্রায় ছিল ৭টি বড়, ৭টি মাঝারি ও ৭টি ছোট মোটিফ। উল্লেখযোগ্য মোটিফগুলোর মধ্যে ছিল:
-
কাঠের বাঘ
-
ইলিশ মাছ
-
শান্তির পায়রা
-
পালকি
-
ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তরমুজের মোটিফ
এছাড়া ছিল সুলতানি ও মুঘল আমলের ১০টি মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, তালপাতার ৮টি সেপাই, ১০টি পলো, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছ ধরার চাই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস।
শোভাযাত্রার রুট
শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহিদ মিনার, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
শোভাযাত্রার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ছায়ানটের আয়োজন, বাউল গান, নৃত্য পরিবেশনা, আবৃত্তি এবং লোকজ শিল্পের প্রদর্শনী এই উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুলিশ, র্যাব এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয়।
পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ
এবারের শোভাযাত্রায় পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটের চট, কাগজ এবং কাঠের উপকরণ দিয়ে মোটিফ তৈরি করা হয়, যা পরিবেশ সচেতনতার বার্তা বহন করে।
সামাজিক বার্তা
শোভাযাত্রার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তরমুজের মোটিফ এবং ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি এই বার্তাকে আরও জোরালো করে তোলে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। এই শোভাযাত্রা আমাদের ঐক্য, সহনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। হাজারো প্রাণের উচ্ছ্বাসে শেষ হলো বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।