অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসে মব সন্ত্রাসে দুই শতাধিক মৃত্যু: ব্যর্থতার দায় কার?
by Shamim Ara Begum
অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসে মব সন্ত্রাসে দুই শতাধিক মৃত্যু: ব্যর্থতার দায় কার?
অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসে ‘মব সন্ত্রাসে’ দুই শতাধিক মৃত্যু, বহু সুন্নি স্থাপনায় হামলা
মব সন্ত্রাসের বিস্তার, একে একে শিল্পকারখানা বন্ধ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা সরকারের বড় ধরনের ব্যর্থতা
মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার
২০২৪ সনের ৫ আগস্ট আওয়ামী ফ্যাসিবাদি শাসনের বিলোপের পর দেশবাসীর বড় প্রত্যাশা ছিল নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দক্ষ নেতৃত্বে দেশের পুঞ্জিভূত জঞ্জালের অবসান ঘটবে। দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে নব্য উদ্যমে। খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল লক্ষ কোটি বেকার যুব তরুণের ভাগ্য বদলে দেবেন ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সে আশায় যেন গুড়ে বালি। দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশায় নিক্ষিপ্ত করে এই সরকার ব্যতিক্রমী কিছু পদক্ষেপ ছাড়া আশিভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নতুন করে দানা বেঁধে ওঠা ‘মব সন্ত্রাস’ রোধে সরকার এই সোয়া এক বছরে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি। মব সৃষ্টি করে গণপিটুনি দিয়ে নিরীহ মানুষ মেরে ফেলা অতীতে তেমন দেখা না গেলেও দুঃখজনকভাবে এখন তাই আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমরা আরো দেখলাম, সুফিবাদি আস্তানা তথা মাজারগুলো খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এর সরকারের সময়ে। সুন্নি আলেম, জনপ্রিয় সুন্নি বক্তারা নানাভাবে হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। এমনকি বহু সুন্নি মাদরাসায় সুন্নিপন্থি অধ্যক্ষ, শিক্ষকরা নাজেহাল হচ্ছে। ভিন্ন মতাদর্শীদের দ্বারা। এই ভীতি সৃষ্টিকারীরা কারা তা আমরা জানি। কিন্তু এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সুন্নি উলামা ছাত্র জনতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে আসার সাহস ও ভরসা পাচ্ছে না। খোদ চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দুটি ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষের কথা তো আপনারা সবাই জানেন। চন্দনাইশ রসুলাবাদ ফাযিল মাদরাসার দীর্ঘদিনের অধ্যক্ষ আল্লামা আ ন ম আহমদ রেজা নক্সবন্দিকে জোরপূর্বক ভয়ভীতি দেখিয়ে মাদরাসা ছাড়া করা হয়েছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী আরেক মাদরাসা জাফরাবাদ ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসায় দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে অধ্যক্ষ পদে থাকা আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল গফুর রিজভিকে জোরপূর্বক মাদরাসা থেকে বিতাড়নে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁর অনুসারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়েছে স্থানীয় বাতিলপন্থী দুর্বৃত্তরা। এমনকি তারা মাদরাসা চত্বরে অধ্যক্ষ রিজভি সাহেবের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করে ভীতিজনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অধ্যক্ষ আল্লামা আবদুল গফুর রিজভির বড় অপরাধ তিনি চট্টগ্রামে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার ছাত্র এবং প্রখ্যাত বক্তা-শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি আহমদ হোসাইন আলকাদেরী (মা.জি.আ) এর মেয়ের জামাতা। তাঁর বিরোধিতাকারী স্থানীয় বাতিলরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন জামেয়ার কোনো ছাত্রকে আমরা এ মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে দেখতে চাই না। দারুল উলূম আলিয়া বা বায়তুশ শরফ মাদরাসার কোনো ছাত্র এ মাদরাসার অধ্যক্ষ হলে আমরা নির্দ্বিধায় মেনে নেবো। দেখুন, কীভাবে বিদ্বেষ-ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সুন্নি আলেম-অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এই হচ্ছে এখন দেশের অবস্থা। বহু সুন্নি মাদরাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ আজ এলাকাছাড়া; তাদের ভয়ে হুমকিতে মাদরাসায় যেতে পারছে না অনেক সুন্নি আলেম। এমনকি চট্টগ্রামসহ দেশের বহু সুন্নি মসজিদে ইমাম-খতিবরা আজ চাকরি হারিয়েছেন বাতিলদের হামলায়-হুমকির মুখে। চট্টগ্রাম নগরের কল্পলোক আবাসিক এলাকায় অবস্থিত সরকারি মডেল মসজিদের খতিব মাওলানা আবু আহমদ আল আযহারী গত বছরের ৫ আগস্ট জোহরের নামাযের পর থেকে আর মসজিদে নামায পড়াতে পারেননি। তিনি সরকারি লেবেলে অনেক তদবির-চেষ্টা করেও স্বপদে বহাল হতে পারছেন না। এই হচ্ছে সুন্নি ইমাম-খতিবদের অবস্থা। অথচ আমরা সুন্নি ঘরানার লোকেরা এই চাকরি হারানো অধ্যক্ষ-ইমাম-খতিবদের স্বপদে বহাল রাখতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছি না।
অন্যদিকে ড. ইউনূস সরকারের আমলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, এই সোয়া এক বছরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শত শত শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে। লাখ লাখ শ্রমিক মেহনতি মানুষ আজ পথে বসেছে। কোথাও কর্মসংস্থান নেই। নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় লাখো কোটি যুব তরুণ আজ চরম বেকারত্বে ধুঁকছে। তাদের হাতে আজ কাজ নেই। ফলে অনেক যুব তরুণ আজ বিপথে পা বাড়াচ্ছে। অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সরকার কবে এই যুব তরুণদের কথা ভাববেন? কী বার্তা দেবেন কর্মহীন তরুণ যুবকদের জন্য? আমরা সরকারের মাঝে বোধোদয় দেখতে চাই। সরকার একটু যুব তরুণদের কথা ভাবুক। না হয় আগামী দিনে কঠিন পরিস্থিতির মুখামুখি হতে হবে দেশ ও জাতিকে। আশাহত তরুণদের মাঝে নতুন করে আশা জাগাতে হবে। তাদের হাতে কাজ তুলে দিতে হবে সরকারকে। এটাই এ মুহূর্তে বড় প্রত্যাশা সরকারের কাছে।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে কয়দিন আগে প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবরে চোখ আটকে গেল। বর্তমান সরকারের ১৫ মাসে সারা দেশে ‘মব সন্ত্রাসে দুই শতাধিক নিরীহ মানুষের মৃত্যু’। গত ৩ নভেম্বর (২০২৫) দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত লিড নিউজের শিরোনাম-‘বেওয়ারিশ লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে’ হত্যার প্রমাণ লুকাতে লাশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। ‘রাজধানীতে এক বছরে ৫৭০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন’Ñচমকে উঠার মতো এই খবর। এদেশে মানুষের মৃত্যু কত স্বাভাবিক, মানুষের যে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই তা উক্ত খবর থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কেন মানুষ এমন অপমৃত্যুর শিকার হবে? কোন অপরাধে ও দোষে দেশে শত শত মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছেÑএর কী জবাব দেবেন সরকার? আমরা মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। কোনো নিরীহ নিরপরাধ মানুষ যেন আর ঘাতকদের হাতে প্রাণ না হারায় সরকারকে এই ভরসা ও নিশ্চয়তা দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদ।