কবরের লাশও আজ নিরাপদ নয় সভ্য দুনিয়ায় ফিরে এসেছে নব্য জাহেলিয়াত
মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার

মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার
কবর থেকে তুলে এনে কোনো লাশ পোড়ানো হয়েছে এমন কোনো নৃশংস বর্বর ঘটনা অতীতে কখনো দেখা যায়নি, শোনাও যায়নি। কিন্তু এবার সেই নৃশংস বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। ‘তৌহিদি জনতার’ নামে আদিম উল্লাসে মেতে ওঠে দেশে কয়দিন আগে (৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫) লাশ পোড়ানোর যে বর্বর ঘটনা ঘটেছে তাকে আপনি কীভাবে দেখবেন? কোনো মানুষ জীবদ্দশায় বিপথগামী হলে বা কোনো পাপাচার-অনাচারে লিপ্ত হলে মৃত্যুর পর কবরে-হাশরে তার ভালো-মন্দের বিচার হবে। পুণ্যবান হলে জান্নাত পাবে। পাপী হলে যেতে হবে জাহান্নামে। পাপের জন্য পাপীকে কবরে আজাবে ভুগতে হবেÑ এটাই ইসলামের বিধি বিধান। তাই মুসলমানরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখেন। দুনিয়ায় কেউ কারো বিচার করতে পারে না। কবর থেকে লাশ তোলে পোড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। কিন্তু রাজবাড়িতে কথিত ‘নূরাল পাগলার’ কবরকে ঘিরে যে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হলো, হাজার হাজার ‘তৌহিদি জনতা’ উল্লাস মেতে ওঠে যে ধরনের নৃশংসতা দেখালো, কবর থেকে নূরাল পাগলার লাশ তুলে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ তার লাশ পুড়ে দিল তা কী নব্য জাহেলিয়তের নমুনা নয়?
এ ঘটনায় কারা ইন্ধন জুগিয়েছে, কারা পরিকল্পনা করে ‘নূরাল পাগলার’ খানকায় হামলা করেছে, কারাই বা তার লাশ পোড়ানোর নৃশংসতায় জড়িত তা প্রশাসন জানেনা এমন নয়। কিন্তু এ বর্বর হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার এবং দৃশ্যমান বিচার আমরা দেখতে পাইনি। সরকারের উপদেষ্টারা শুধু গণমাধ্যমে ‘বিবৃতি’ দিয়ে দায় সেরেছে। ‘মব সন্ত্রাস কিংবা লাশ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িতরা ছাড় পাবে না’ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও কয়জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সরকার কেন মব সন্ত্রাস থামাতে পারছে না। বর্তমান সরকার তো রাজনৈতিক সরকার নয়। কারো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের দায় নেই এ অন্তবর্তী সরকারের। রাজবাড়িতে সংঘটিত এ নৃশংস বর্বর হামলা ঠেকাতে সরকারের প্রশাসন বেশ তৎপর ছিল তা বলা যাচ্ছে না। বরং উত্তেজিত মারমুখী জনতাকে নিবৃত্ত করতে পুলিশ ভয় পেয়ে যায়। ফলে ঘটনা পুলিশ সামাল দিতে পারেনি। পুলিশই যদি উন্মত্ত সন্ত্রাসীদের থামাতে না পারে, আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারে, সর্বস্তরের জনগণকে নিরাপত্তা দিতে না পারে কিংবা সব মত পথের মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় তাহলে জনগণ কার ওপর ভরসা রাখবে? কে দেবে জনগণের নিরাপত্তা এবং জনস্বস্তি? রাজবাড়ির নূরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা সর্বশেষ ঘটনা নয়, এ ধরনের আরো বহু নৃশংস ঘটনা সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে।
ময়মনসিংহে এক বাউল সাধকের চুল দাড়ি ছেঁটে ফেলার ঘটনাও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। দেশটা যেন কথিত ‘তৌহিদি জনতার’ অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই তৌহিদি জনতা কারা তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না। তাদের পরিচয় জানাই আছে। যারা নবী ওলীবিদ্বেষী, মাজার বিদ্বেষী তারাই এখন ‘তৌহিদি জনতার’ বেশ ধরে সারা দেশে ঘৃণ্য উন্মত্ততা চালাচ্ছে। সুন্নি সুফিবাদি তরিকতপন্থি জনতাই আজ তাদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। অথচ সুন্নি সুফিবাদি জনতা কারো প্রতিপক্ষ নয়। তাঁরা সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী তাঁরা। তবুও দুঃখজনক যে, তারা আজ আক্রান্ত হচ্ছে। উন্মত্ত ‘তৌহিদি জনতা’কে অবিলম্বে থামাতে হবে। তাদের রাশ এখনই টেনে ধরতে হবে সরকারকে।
লেখক : রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যাংকার। প্রকাশক : প্রথম বসন্ত