
সুন্নিঘরানার শিল্প প্রতিষ্ঠানে আমাদের যুবকদের চাকরি হয় না কেন?
শত শত সুন্নিমনা তরুণ-যুবক আজ বেকারত্বে ধুঁকছে সুন্নিঘরানার শিল্প প্রতিষ্ঠানে আমাদের যুবকদের চাকরি হয় না কেন? সুন্নি সংগঠক, রাজনীতিবিদ, বক্তা ও সিনিয়র আলেমগণের এক্ষেত্রে নীরবতা আর দেখতে চাই না আ ব ম খোরশিদ আলম খান ব্যাংকার, সংগঠক রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা ১৯৯৫ সনে চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে একই বছরে কামিল (হাদিস) উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী। মাসিক প্রথম বসন্তে দীর্ঘদিন ধরে ফজলু ভাইয়ের ফরমায়েশ পেয়ে লিখে যাচ্ছি। বছর তিনেক-চারেক ধরে বিরতি ছাড়াই প্রতি মাসেই লিখছি। দু’দিন আগে ফজলু ভাইয়ের কড়া ফোন। এখনো লেখা দেওনি কেন? ভাবছি এবার কি লিখবো। লেখার প্রসঙ্গ তো অনেক আছে। বহু বিষয়ে তো লেখা যায়। এবার ভাবছি, একটি ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ে লিখবো। প্রায় এক যুগ আগে ছাত্রসেনার একটি ম্যাগাজিনেও এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ কলম ধরেছিলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুন্নি অঙ্গনের রাজনীতিবিদ, সংগঠক, আলেম, সিনিয়র বক্তা এবং সুন্নিমনা শিল্পপতি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টনক নড়াতে পারিনি। তাই আবার কলম ধরা। আমার কথা স্পষ্ট। দেশে শত শত হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে সুন্নি তরিকতপন্থি, সুন্নি আক্বিদায় বিশ্বাসী অনেক শিল্পপতি ও ধনাঢ্য ব্যক্তি আছেন। তাঁদের শিল্প কারখানায় শত শত হাজার হাজার লোক কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিশ্চয়ই কাজ করে থাকেন। এই সুন্নিমনা ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শিল্পপতিদের শিল্প কারখানায় সুন্নিমনা যুব তরুণদের কতোজন চাকরি পেয়েছে বা পাচ্ছে একটু পরিসংখ্যান দিয়ে আমাকে বলবেন কী? সুন্নি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট বা গাউসিয়া কমিটি করেন, এমন অনেককে আমি চিনি ও জানি, যারা যুগ যুগ ধরেই বেকারত্বে ধুঁকছেন। তাঁরা রাস্তায় রাস্তায় চাকরির আশায় ঘোরেন। কিন্তু তাদের কেউ চাকরি দেয় না। কিংবা বড় কোনো শিল্পপতি ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে সুন্নি সংগঠকদের কেউ বলেন না | ভাই আমার বেকার নেতকর্মীদেরকে একটা চাকরি দিন। অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখা যায় অসুন্নি অন্যান্য ঘরানার লোকদের বেলায়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজত এবং তবলিগি ঘরানার নেতৃস্থানীয় শিল্পপতি ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বেছে বেছে তাদের মতাদর্শী-নেতাকর্মীদেরকে নিজ নিজ শিল্প প্রতিষ্ঠানে আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি দিয়ে থাকে। বিশেষ করে জামায়াত ইসলামীর কথাই ধরুন। একজন শিবির নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব পেরিয়ে গেলে চাকরির জন্য টেনশন করতে হয় না। হন্য হয়ে চাকরি খুঁজতে হয় না। জামায়াতের নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেছে বেছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের চাকরি দেয়া হয়। তাদের রয়েছে অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠান। যেখানে শত শত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। একজন ছাত্র কেন ছাত্রশিবির করবে না? সে তো শিবিরকর্মী বলেই কর্মজীবনে এসে লোভনীয় চাকরি পাচ্ছে। তার জন্য যোগ্যতানুসারে অসংখ্য চাকরির দরোজা খোলা। তাহলে সে অবশ্যই তো জামায়াত-শিবির করে সার্বিকভাবে লাভবান হতে পারছে। সরকারি-বেসরকারি চাকির যেখানে এদেশে সোনার হরিণ সেখানে একজন শিক্ষার্থী যদি নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে চাকরির নিশ্চয়তা পায়, তাহলে ওই শিক্ষার্থীকে জামায়াত-শিবিরের বলয় থেকে অন্য বলয়ের দিকে নিয়ে আসা তো বেশ কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। কে না চায় সুন্দর কর্মময় জীবন! আর আমরা সুন্নিরা? আমাদের না আছে ব্যাংক, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিশ্ববিদ্যালয় বা নানামুখী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান! সব জায়গায় আমরা পিছিয়ে। কেবল মাঠে ওয়াজ মাহফিলে গরম গরম বক্তৃতা দিয়েই আমাদের কাজ যেন শেষ। ছাত্রসেনা, যুবসেনা, ইসলামী ফ্রন্ট, গাউসিয়া কমিটি বা অন্য কোনো সুন্নি সংগঠনের কয়জন নেতাকর্মীর সুন্নি ঘরানার শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়েছে বলুন? এই সুন্নিমনা শিল্পপতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রেখে সুন্নিমনা তরুণ-যুবকদেরকে আমরা চাকরি দিতে পারছি কী? সুন্নি রাজনীতিবিদ, সংগঠক, সুন্নি উলামা পীর মাশায়েখ এবং বক্তাগণ চাইলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতি বছর তাঁর অধীনস্থ যুব-তরুণদেরকে চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেন। সুন্নি শিল্পপতি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে তদবির-চেষ্টা করে অন্তত কিছু যুবকের চাকরির ব্যবস্থা করা কঠিন কোনো কাজ নয়। দরকার শুধুÑদরদ, মানসিকতা ও সদিচ্ছা। এবার, আমার নিজের কিছু কথা বলে এই লেখার ইতি টানবো। আজ হতে বিশ বছর আগে ২০০৫ সনের ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আজাদীতে সাংবাদিক হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো আমার চাকরি হয়। ১৯৯৭ সনে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঈশানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় আমার প্রবেশ। ২০১৯ সনে করোনার অভিঘাত পত্রিকা জগতেও আছড়ে পড়ে। ফলে আমরা যাদের চাকরির বয়স ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে এবং বেতনও পঁচিশ হাজারের চেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা চারজন টার্গেটে পড়ে চাকরি হারালাম। আমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, শুধুমাত্র পত্রিকার খরচ কমাতে আমাদের আপসে বিদায় দেয়া হলো। আড়াই লাখ টাকা পাওনাও বুঝিয়ে দেয়া হলো। ২০২০ সনের ২২ আগস্ট থেকে ২০২২ সনের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক আজাদীতে দীর্ঘ এক বছর চার মাস আমার চাকরি ছিল না। একদিকে করোনার ছোবল। অন্যদিকে বেকারত্বÑকী দুর্বিষহ অবস্থা আমার! করোনার দিনে কে দেবে আমাকে চাকরি! ২০২১ সনের নভেম্বরের দিকে একদিন জুমা পড়লাম চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি জামে মসজিদে। এ মসজিদে খতিব হলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু ছোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক শায়খুল হাদিস আল্লামা কাযী মুঈন উদ্দিন আশরাফী সাহেব। এ মসজিদে প্রায়ই জুমার নামাজ পড়েন পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আলহাজ¦ সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। আশরাফী সাহেব হুজুরের মাধ্যমে সুফি সাহেবের হাতে একটি দরখাস্ত দিলাম। চাকরির দরখাস্ত। আশরাফী হুজুর বললেন, খোরশিদ হচ্ছে অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খানের (রহ) ছেলে। আজাদীতে সাংবাদিক হিসেবে ছিল দীর্ঘদিন। করোনায় এখন তার চাকরি নেই। সে জমিয়তুল ফালাহ কারবালা মাহফিলে দীর্ঘদিন ধরে নিউজ লিখ আসছে। সব শুনে সুফি সাহেব বললেনÑ‘চাকরি নেই। গ্রামে গিয়ে গরু ছাগলের খামার করো।’ সুফি সাহেবের একথায় সেদিন বেশ আশাহত হলাম। এতো বছর ধরে কারবালা মাহফিলের নিউজ করে আসছি। সুফি সাহেব আমাকে নিশ্চয়ই জানেন ও চিনেন। আমার আব্বার ইন্তেকালের পর আমাকে ডেকে নিয়ে আব্বার জেয়াফতের জন্য লাখ টাকার একটি চেক আমার হাতে দিয়েছিলেন সুফি সাহেব। আজ তিনিই কিনা আমার চাকরির দরখাস্ত নাকচ করে দিলেন। আমার বেশ দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। যাক, একরাশ হতাশা ও আক্ষেপ নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরি। সুফি সাহেবের বিশটির বেশি শিল্প কারখানায় এখন অন্তত ৫০ হাজার লোক চাকরি করেন। আমার প্রশ্ন এদের মধ্যে কতোজন সুন্নি ঘরানার? আমাদের সুন্নি রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও উলামা মাশায়েখের মধ্যে কতোজন সুফি সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে সুন্নিমনা যুব-তরুণদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছেন? এর উত্তর ‘না’। নিজেরা নিজেদের ধান্ধার জন্য অনেকে শিল্পপতি-ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে সমীহ করে চলেন। অথচ সুন্নিমনা যুব-তরুণদেরকে চাকরি দেয়ার জন্য তাঁরা একবারও চেষ্টা করে দেখেন না। দ্বীন, মাজহাব মিল্লাত এবং মানবতা তাঁদের কাছে মুখ্য নয়। নিজেদের লাভালাভ তাঁদের কাছে মুখ্য। অবশ্য সেদিন আমার চাকরির দরখাস্ত প্রত্যাখ্যানের কারণে আশরাফী সাহেব হুজুর বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। হুজুর তৎক্ষণাৎ আমাকে বলেছিলেন, দেখ খোরশিদ, সুফি সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল। কিন্তু কাউকে চাকরি দেয়ার সুপারিশ করলে তা তিনি রাখেন না। কেন রাখেন না তা আমি বলতে পারবো না। তিনিই ভালো জানেন। সুন্নি ধনাঢ্য শিল্পপতিদের সঙ্গে সখ্য সম্পর্ক রাখা, ঘনিষ্ঠতা এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলা যে কতো বড় জরুরি সেদিন আমি বুঝেছি। আমাদের জনাব আশরাফী, মতিন-সামাদ-বখতিয়ার সাহেবেরা যদি এদিকে একটু খেয়াল রাখতেন, আমাদের যুব-তরুণরা বেশ উপকৃত হতেন। অন্য ঘরানার ধনাঢ্য শিল্পপতিরা যদি বেছে বেছে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিজেদের মতাবলম্বী-অনুসারীদের চাকরি দিতে পারেন, আমাদের সুন্নি ঘরানার শিল্পপতিদেরকে কেন এজন্য আমরা উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে পারবো না। দরকার শুধু সদিচ্ছা এবং সহমর্মিতা। প্লিজ, আমাদের বেকার তরুণদের দিকে তাকিয়ে সুন্নি সংগঠকরা একটু মানবিক ও দরদী হোন। সেই সঙ্গে নানামুখী আর্থিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সুন্নি যুব-তরুণদের চাকরির ব্যবস্থা করুন প্লিজ। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই কাজে আর দেরি নয়।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক।