ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদাসীনতা কেন?
কেবল ‘সংস্কার সংস্কার’ বুলি নয়, দেশবাসী চায় যৌক্তিক এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্র্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার দেশের বড় ক্রান্তিকালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে দেশকে বড় বিপর্যয় হতে বাঁচিয়েছেন। ২০২৪ সনের ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেয়। ইতিমধ্যে ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় দেশে এখনো বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। যদিও বা একটি সরকারের জন্য ছয় মাস খুব বেশি সময় নয়। ড. ইউনূসও বলেছেন, তাঁর সরকার ছয় মাসের প্রথম ধাপ পার করেছে। এখন থেকে দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু হলো। এর আগেও তিনি বলেছেন, দেশে নির্বাচনী ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। চলতি ২০২৫ সনের ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা বড়জোর আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে প্রফেসর ইউনূস বারবার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে আসছেন। তিনি স্পষ্টভাবে এও বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো খুব বেশি সংস্কার না চাইলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে তিনি দেরি করবেন না। ড. ইউনূস বলেন, দেশবাসীর আশা আকাক্সক্ষার ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণই ঠিক করে দেবে কখন জাতীয় নির্বাচন হবে। একথা ঠিক যে, বিগত পতিত সরকার দেশে যে জঞ্জাল রেখে গেছে তা ঠিক করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। দেশের সব সেক্টরে হাত দিতে হবে। কারণ, সকল সেক্টরেই এখন ভঙ্গুর দশা। রাষ্ট্রের সকল কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। দীর্ঘ পনের বছর দেশে কোনো নির্বাচনই হয়নি। দেশে কোটি কোটি যুবকের ভোটার হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে। অথচ তারা ভোটারই হয়নি। অথবা ভোটার হলেও ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়নি ভোট ডাকাত আওয়ামী সরকারের কারণে। দীর্ঘ পনের ষোল বছর ধরে দেশবাসী আওয়ামী দুঃশাসন দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়লেও কোনো কিছুই করার ছিল না। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় কিংবা বিরোধী দলের ওপর নানামুখী দমন-নিপীড়নের কারণে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথও দেশবাসীর সামনে খোলা ছিল না। পতিত সরকার ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সনের ৭ জানুয়ারি ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করলেও তা দেশবাসীর কাছে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি পাতানো প্রহসনের নির্বাচন দেখেছে সমগ্র বিশ্ব। ফলে পতিত সরকারের তলার মাটি দিন দিন সরে পড়তে থাকে। সরকারি চাকরিতে বৈষম্য সৃষ্টিকারী কোটা প্রথা বাতিলের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কোনো স্বৈরশাসক যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গণবিরোধী অবস্থান নিয়ে মসনদে টিকে থাকতে পারে না তার বড় দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বারবার বলতেন, ‘বিএনপি আমার পতন চায়, আমার পর তারা কার হাতে দেশ পরিচালনার ভার তুলে দেবে?’Ñতাঁর এ বক্তব্য ছিল জঘন্য আপত্তিকর। একটি দেশে যুগ যুগ ধরে একজন নেতা-নেত্রী দেশ শাসনে থাকবে, জনগণ না চাইলেও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে হবেÑ এমন বালখিল্য আচরণ ও দম্ভ শেখ হাসিনাকে একেবারে মাটিতে নেমে এসেছে। প্রফেসর ড. ইউনূস আর যাই হোক দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। এমনকি নোবেল লরিয়েট। বাংলাদেশকে বিশ্বে অনেকে চেনে প্রফেসর ইউনূসের দেশ হিসেবে। এমন সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে কতোভাবে যে হেনস্তা ও নিগৃহ করেছেন শেখ হাসিনা তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। ইতিহাসের মধুর প্রতিশোধ আমরা দেখেছি। শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ শাসনের আর কোনো নেতা-নেত্রী দেশে নেই তা মিথ্যা প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি। যাক, সেই কাসুন্দি আমরা ঘাঁটতে চাই না। শেখ হাসিনা এখন তার কর্মফল ভুগছেন। আর বিজয়ী বীর প্রফেসর ড. ইউনূসের হাতে পড়েছে ১৮ কোটি মানুষের দেখভালের দায়িত্ব। আল্লাহ পাকের এই ফয়সালা না মেনে কোনো উপায় আছে? ইজ্জত দেয়ার মালিক আল্লাহ পাক। আর দাম্ভিক স্বৈরশাসকের পতনও হয় মহান আল্লাহ পাকের হুকুমে। যা আমরা এখন বাস্তবে দেখছি। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েই ড. ইউনূস দেশের গণতান্ত্রিক উত্তোরণে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করবে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। আমরা আশা করবো সরকার যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অর্থাৎ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হবে। শুধু মুখে ‘সংস্কার সংস্কার’ বুলির পরিবর্তে সত্যিকার অর্থে সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের পথে হাঁটবে সরকারÑতাই আজ দেশবাসীর প্রত্যাশা। অন্যদিকে, নিত্যপণ্য বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম আজ লাগাম ছাড়া। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুনসহ সব ভোগ্যপণ্যের দাম আজ হু হু করে বাড়ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে হঠাৎ উধাও। প্রতি কেজি সয়াবিনের দাম এখন ২০০ টাকা। বাজারে এই উত্তাপ কেন? বাজার দরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কেন নেইÑএই জিজ্ঞাসা আজ দেশবাসীর। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা এবং দ্রুত সময়ের জাতীয় নির্বাচনের দিকে হাঁটা এই তিনটি কাজকে সরকার যেন অগ্রাধিকার দেয়। না হয় সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হবে। যা কখনো কারো জন্য মঙ্গলজনক হবে না। লেখক: ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক, সংগঠক। প্রকাশক: মাসিক প্রথম বসন্ত।