
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর
ফ্যাসিস্ট বিতাড়ন সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থানের
আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়ে গেল
মুহাম্মদ ফজলুল করিম তালুকদার
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার গত বছরের এই সময়ে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিলেও দেশ এখনো পুরোপুরি ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়নি। এখনো ফ্যাসিবাদের গর্জন-তর্জন শোনা যায়। শেখ হাসিনা ফিরে আসবে এমন দুঃস্বপ্ন কেউ কেউ হয়তো দেখছে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে আগামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন দেয়ার রূপরেখা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করায় দেশবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। নির্বাচন নিয়ে সংশয়, শঙ্কা ও ধোঁয়াশা কেটে গেছে। তবে এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সাফল্য যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতার পাল্লাও খুব ভারী বলতে দ্বিধা নেই। সরকার অর্থনীতিতে একটা স্থিরতা আনতে সচেষ্ট। এতে কিছুটা সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন বিনিয়োগ ও বেকারত্ব নিরসনে সরকার খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। দেশে এই এক বছরে শত শত শিল্প প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে দুঃসহ জীবন পার করছে। বিশেষ করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বড় বড় কিছু ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন শিল্প কারখানাগুলোতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক কারখানা লে-অফ ঘোষিত হয়েছে। ফলে অনেক শিল্প কারখানার শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন-মজুরি পাচ্ছে না। পরিবার পরিজন নিয়ে কর্মচ্যুত শ্রমিক-কর্মচারীরা আজ মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খুবই শোচনীয়। বহু ব্যাংক খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। লাখ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের কারণে ওই ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা করা যাচ্ছে না। গত ১৬ বছরে ব্যাংক থেকে তিন লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হলেও এক টাকাও ফিরিয়ে আনা যায়নি। কয়েকটি ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করার সরকারি পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। এতে ব্যাংকগুলোতে কর্মরতরা ছাঁটাইয়ের শিকার হবে না বলা হলেও বাস্তবে অনেক ব্যাংককর্মী আজ চাকরিচ্যুত হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে অস্থিরতা-অস্বস্তি লেগেই আছে। অথচ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ উদ্ধারে এবং পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বর্তমান সরকার সত্যিকার অর্থে আন্তরিক ও সচেষ্টা হলে খেলাপি ঋণ উদ্ধার ও পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনা কঠিন কোনো কাজ নয়। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যর্থতা দেশবাসীকে আশাহত করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না – এটা বড় দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক যে, গণমাধ্যমে এসেছে দেশে গত এক বছরে প্রায় ১২৩ টি হত্যাকাণ্ড ও মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষে গত ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার গাজীপুরে আসাদুজ্জমান তুহিন নামে (বয়স ৩৮) এক সাংবাদিককে গলা কেটে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এই সাংবাদিক বিকেলে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মোবাইলে পোস্ট দিয়েছিল। রাতেই তাকে স্থানীয় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা জবাই করে খুন করে। এই হচ্ছে এখন দেশের অবস্থা। এর আগে গত এপ্রিল মাসে ঢাকা নারায়ণগঞ্জেও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সাবেক নেতা ইমাম মাওলানা রইস উদ্দিনকে ‘মব’ সৃষ্টি করে জঘন্যভাবে পিটিয়ে খুন করে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। অথচ এর কোনো বিচার হচ্ছে না। ‘মব সন্ত্রাস’ (ভীতি-আতংক সৃষ্টি করে কাউকে গণপিটুনি দেয়া বা মেরে ফেলা) কেন এই এক বছরে বেড়ে গেল তা দেশবাসীর বুঝে আসে না। এখন তো স্বৈরাচার নেই, ফ্যাসিস্ট সরকার নেই। তবুও কেন মব সন্ত্রাস বাড়বে? অন্তর্বর্তী সরকার তাহলে কী করছে? আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং জননিরাপত্তা দিতে সরকার কেন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। জনগণ সরকারের ওপর কেন ভরসা ও আস্থা রাখতে পারছে না? মব সন্ত্রাস ঠেকাতে সরকারের দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ কেন চোখে পড়ছে না? এর কী জবাব দেবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা?
আমরা চারপাশে আরো কী দেখছি? দেশের সুন্নি উলামা ছাত্র জনতা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। তবুও এই সরকারের আমলে সুন্নিরা আজ সর্বত্র কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সুন্নিরা আজ নানাভাবে উপেক্ষা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের শিকার। সরকার গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সুন্নিদের টার্গেট করে দেশের নানা স্থানে নৈরাজ্য ও ভীতিময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। দেশের নানা স্থানে মসজিদ মাদ্রাসায় সুন্নি আলেম ইমাম খতিবদেরকে হুমকি ধমকি দিয়ে ও নানাভাবে নিগ্রহ করে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করার চরম দুঃসাহস দেখাচ্ছে সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সুন্নি বিদ্বেষী চক্রটি। অনেক মসজিদে সুন্নি ইমাম খতিবদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক সুন্নি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ শিক্ষকদেরকে মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত করে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। বহু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আজ মাদ্রাসাছাড়া। বাতিল ফের্কা তথা বিকৃত মতাবলম্বীদের হামলা-হুমকির শিকার হয়ে বহু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আজ মাদ্রাসায় যেতে পারছেন না। অনেক সুন্নি আলেম ইমাম ও মাদ্রাসা অধ্যক্ষ তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হয়ে আসছে। এখানে আমি দুইজনের সুনির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরতে পারি। চট্টগ্রাম চন্দনাইশের জাফরাবাদ ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সুন্নি ঘরানার আলেম অধ্যক্ষ আল্লামা আব্দুল গফুর রিজভি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় বাতিল ফের্কার হামলা-হুমকির শিকার হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে মাদ্রাসায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁর বিরুদ্ধে কৃত্রিম আন্দোলন তথা বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছে এই সুন্নি বিদ্বেষী চক্রটি। অন্যদিকে, চন্দনাইশের আরেকটি বড় মাদ্রাসা রসুলাবাদ ফাজিল মাদ্রাসায়ও একই ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে অধ্যক্ষ আল্লামা আ ন ম আহমদ রেজা নকশবন্দীকে মাদ্রাসায় যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই সুন্নি আলেম মাদ্রাসাছাড়া। এখানে কেবল চন্দনাইশের দুইটি মাদ্রাসার কথা বললাম। সারা দেশে উত্তরবঙ্গে, দক্ষিণ বঙ্গে এমনকি রাজধানী ঢাকায়ও বহু সুন্নি আলেম ইমাম খতিব মাদ্রাসা অধ্যক্ষ আজ বাতিলদের দ্বারা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
সমূহ বিপদ-বিপর্যয় মোকাবিলায় আজ দেশের সকল সুন্নি সুফিবাদি তরিকতপন্থি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সুন্নিয়তের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মাধ্যমে সুন্নিয়তের রাজনীতির যে ধারা দেশে আছে তাকে আরো বিকশিত ও শক্তিশালী রূপ দিতে হবে। সুন্নিরা এখন না ঘরকা, না ঘাটকা। কেউ তাদের মূল্যায়ন করছে না। মর্যাদা দিতে চাচ্ছে না। এই দুরবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না।
আগামী ডিসেম্বরে দেশে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হবে। হাতে বেশি সময় নেই। ইসলামী ফ্রন্ট তথা সুন্নি নেতৃত্বকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠতে হবে। এখন থেকে সারা দেশে অন্তত ১০০ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে হবে। তবে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ৫/৭/৮ টি আসনকে টার্গেট করে এমপি হিসেবে জয়ী হয়ে আসতে প্রার্থীদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি প্রতীকে সব সুন্নি যাতে একযোগে ভোট দেয় এজন্য গণজাগরণ গড়ে তুলতে হবে। সর্বস্তরের সুন্নিদের মাঝে সচেতনতা ও ঐক্য গড়ে তোলার কথা এখনই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ভাগেই সারা দেশে স্লোগান তুলতে হবে – ‘সব সুন্নির মার্কা কী – মোমবাতি-মোমবাতি’।
লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক, ব্যাংকার। প্রকাশক : মাসিক প্রথম বসন্ত