জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি : সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল
গোলাম মোস্তফা মুহাম্মদ নুরুন্নবী
যুগে যুগে কিছু মহীয়সী চরিত্র ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এমন দীপ্তি ছড়ায়, যা কখনো ম্লান হয় না, বরং কালস্রোতে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁদের জীবন শুধু এককালের নয়; বরং তা চিরন্তন আদর্শ, অফুরন্ত শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির আলোকবর্তিকা হয়ে থাকে। হযরত ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)Ñএমনই এক মহান রত্ন, যিনি ছিলেন নবুয়তের আলোয় স্নাত, জান্নাতের নারীদের শিরোমণি, ধৈর্যের ও পরম ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন পিতার ভালোবাসার অমূল্য ধন, স্বামীর হৃদয়ের প্রশান্তি ও সন্তানদের আদর্শ গর্ব। রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, “ফাতিমা আমারই অংশ।” (সহিহ বুখারি) তাঁর ব্যক্তিত্বে একদিকে ছিল আধ্যাত্মিকতার মহিমা, অন্যদিকে ছিল পার্থিব ত্যাগের সৌন্দর্য; একদিকে ছিল বিনয়, অন্যদিকে ছিল আত্মমর্যাদার গাম্ভীর্য।
হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.)’র প্রাথমিক জীবন
জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি: সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল (রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি প্রিয় নবি (দ.)’র সবচেয়ে ছোট কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রিয় ও আদরের শাহজাদী ছিলেন। তাঁর নাম ছিলো “ফাতিমা”। তাঁর অনেক উপাধি রয়েছে, “বাতুল” অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, কেটে যাওয়া, যেহেতু তিনি পৃথিবীতে বসবাস করেও পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, দুনিয়ায় মন লাগাননি, তাই “বাতুল” উপাধি হয়েছিলো, “যাহরা” অর্থ কলি, তিনি (রাদ্বি.) হলেন, “জান্নাতের কলি” তাঁর শরীর মুবারক থেকে জান্নাতের সুগন্ধি আসতো, যার ঘ্রাণ রাসুল (দ.) নিতেন, তাই তাঁর উপাধি হলো “যাহরা”। (মিরআতুল মানাজিহ, ৮/৪৫২, ৪৫৩)। চারিত্রিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি আরও অনেক উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর পিতা ছিলেন সায়্যিদুল কাওনাইন, ইমামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ (দ.) এবং মাতা ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম নারী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাদ্বি.)। তাঁর জন্মসাল নিয়ে ঐতিহাসিক ওলামাদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। আবু ওমরের মতে নবুয়্যত ঘোষণার পরের বছর যখন প্রিয় নবি (দ.)’র বয়স শরিফ একচল্লিশ বছর ছিলো তখন তাঁর জন্ম মুবারক হয় এবং আল্লামা ইবনে জাওযী লিখেন, নবুয়ত ঘোষণার পাঁচ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম মুবারক হয়। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনইয়া ওয়া শরহুয যুরকানি, বাবু যিকরি আওলাদে কিরাম)। হযরত মা ফাতিমা (রাদ্বি.)’র দৈহিক গঠন মুবারক প্রিয় নবি (দ.)’র ন্যায় ছিলো। তাঁর দেহ মুবারক চাঁদের প্রস্ফুটিত ছিলো। তাঁর মুখমণ্ডল হাস্যোজ্জ্বল থাকতো, তবে চেহারায় গাম্ভীর্য পরিলক্ষিত হতো। তাঁর ওষ্ঠ মুবারক ছিলো রক্তিম। তিনি প্রিয় নবি (দ.)’র প্রতিচ্ছবি ছিলেন। মা ফাতিমা (রাদ্বি.) যে সময় প্রিয় নবি (দ.)’র নুরানী কোলে থাকতেন, সে সময় আল্লাহর কুরআন নাযিল হতো। ঐশ্বীবাণীর ফয়েজ ও বরকতের ভাগী হতেন নবি দুলারী এবং নবুয়তী পরিবেশে স্নেহ-মায়া-মমতা পেতে থাকতেন। এটা কতই না সুন্দর ও সৌভাগ্যময় মুহূর্ত! যা পরবর্তী নুরানী কৈশোর জীবনের ভিত্তি ছিলো।
শাহজাদীয়ে কাওনাইন (রাদ্বি.)’র পারিবারিক জীবন
জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি: সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল (রাদিয়াল্লাহু আনহা। ২য় হিজরি সফর বা রজব শরিফ বা রমযানুল মুবারকে আমিরুল মু’মিনীন হযরত মাওলা মুশকিল কুশা, আলীয়্যূল মুর্তাযা শেরে খোদা (রাদ্বি.)’র সাথে খাতুনে জান্নাত বিবি ফাতেমাতুয্ যাহরা (রাদ্বি.)’র বরকতময় বিবাহ সংঘটিত হয়। তাঁদের তিনজন শাহজাদা: হযরত ইমাম হাসান মুজতবা, সৈয়্যদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন ও হযরত মুহসিন (রাদ্বি.) আর তিনজন শাহজাদী: হযরত সায়্যিদা বিবি যায়নাব, হযরত রুকাইয়া ও হযরত উম্মে কুলসুম (রাদ্বি.)। আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে উভয় জগতের মালিক ও মুখতার এর শাহজাদী হয়েও মা ফাতিমা (রাদ্বি.) অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। মওলা আলী (রাদ্বি.) বলেন, গৃহস্থালির কাজ (যেমন: পেষণ, ঝাড়ু দেয়া, রান্না করার কাজ) হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) করতেন এবং বাইরের কাজ (যেমন: বাজার থেকে জিনিসপত্র আনা, উটকে পানি পান করানো ইত্যাদি) আমি করতাম। (মুসান্নাফে
ইবনে আবী শায়বা, হাদিস: ১৪)। হযরত ফাতেমাতুয যাহরা (রাদ্বি.) আমার পাশে নিজের হাতে চাক্কি পিষতেন, যার কারণে তাঁর হাতে দাগ পড়ে যেত এবং নিজেই পানির মশক ভরে আনতেন আর ঘরে ঝাড়ু ইত্যাদি নিজেই দিতেন। (আবু দাউদ, হাদিস: ৫০৬৩)। তাঁর কষ্টের কথার অনুভব করে মওলা আলী (রাদ্বি.) বারগাহে রিসালতে খাদেম নিয়োগের কথা উপস্থাপন করেন। তখন নবি করিম (দ.) তাঁদেরকে খাদেমের পরিবর্তে এমন একটি তদবীর দিলেন যা উভয় জগতের জন্য কল্যাণকর এবং যে খাদেম চাচ্ছে সেই খাদেম থেকে উত্তম। অতঃপর হুজুর (দ.) ইরশাদ করলেন, তোমরা যখন বিছানায় আরাম করতে যাবে তখন ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ আর ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আর ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়বে। এই তাসবিহগুলো তোমাদের কাক্সিক্ষত খাদেম থেকেও উত্তম।
পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে মা ফাতিমা (রাদ্বি.)’র ফাযায়িল
নবি পরিবার তথা হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) পূতঃ পবিত্র: এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন, “ওগো নবীর বংশধর। আল্লাহ তাআ’লার ইচ্ছা হল যে, তোমাদের থেকে প্রত্যেক ধরনের অপবিত্রতা দূরীভূত করবেন এবং তোমাদেরকে সর্বদিক দিয়ে পুতঃপরিত্র রাখবেন”। (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৩)। রাসুল (দ.) ইরশাদ করেন, “আমি এবং আমার আহলে বাইত পাপ থেকে মুক্ত। এ আহলে বাইতের মধ্যে হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) অন্তর্ভুক্ত। সুরা দাহরের ৮-১১ আয়াতে হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) ও তাঁর পরিবারের প্রশংসা করা হয়েছে এভাবে : “তারা তাঁর (আল্লাহর) ভালবাসায় অভাবগ্রস্ত,অনাথ ও বন্দীকে আহার্য দান করে। এবং বলে,‘কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার প্রদান করি,আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না,কৃতজ্ঞতাও নয়,আমরা আশংকা করি আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এক ভীতিপ্রদ দিনের,সেদিন মুখমণ্ডল বিকৃত ও বিবর্ণ হয়ে যাবে’; পরিণামে আল্লাহ তাদের সেদিনের কঠিন পরিস্থিতি হতে রক্ষা করবেন এবং তাদের দান করবেন উৎফুলতা ও আনন্দ। আর ধৈর্যশীলতার প্রতিদানস্বরূপ তাদের প্রদান করবেন জান্নাত ও রেশমী বস্ত্র।” এ ঘটনা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন : একদিন ইমাম হাসান ও হুসাইন পীড়িত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (দ.) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে তাঁদের দেখতে গেলেন এবং তাঁদের রোগমুক্তির জন্য হযরত আলীকে রোযা মানত করতে বললেন। হযরত আলী ও ফাতিমা রোযার মানত করলেন। তাঁদের রোগমুক্তির পর হযরত ফাতিমা তাঁর পরিজন নিয়ে রোযা রাখা শুরু করলেন। তাঁরা পরপর তিনদিন রোযা রাখার নিয়্যত করেছিলেন। প্রথম দিন হযরত ফাতিমা ইফতারের জন্য পাঁচটি রুটি তৈরি করলেন। যখন তাঁরা ইফতারের জন্য খাবার নিয়ে বসেছেন সে সময়ে একজন মিসকিন এসে খাবার চাইল। তাঁরা তাঁদের খাবারের পুরোটাই সেই মিসকিনকে দিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে একইভাবে ইফতারের সময় যথাক্রমে একজন ইয়াতিম ও একজন বন্দী তাঁদের কাছে খাবার চাইল। তাঁরা পরপর এ তিনদিনই কেবল পানি দিয়ে ইফতার করলেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই সুরা দাহর নাযিল হয়। (তাফসীরে দুররুল মানসুর)। আহলে বাইত তথা মা ফাতিমা (রাদ্বি.)’র মুহাব্বতই ঈমান। আল্লাহ তাআ’লা ইরশাদ করেন, “ওহে আমার হাবীব! আপনি বলে দিন, হে মানব জাতি (বিশেষত ঈমানদাররা)। আমি তোমাদের থেকে হেদায়ত ও রিসালতের বাণী প্রচারের উপর তোমাদের নিকট আমার অতি নিকটতম আপনজন ও আত্মীয়দের প্রতি ভক্তি ও মুহাব্বত ছাড়া আর কিছু তালাশ করছি না।” এ আয়াতে কারীমা নাযিল হবার পর হযরত ইবনে আববাস (রাদ্বি.) হুজুর (দ.) এর দরবারে আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (দ.) ! আপনার এই আত্মীয় কারা? যাদের ভালবাসা আমাদের উপর কুরআন শরিফের আয়াতের দ্বারা ওয়াজিব হয়েছে? প্রত্যুত্তরে হুজুর (দ.) ইরশাদ করেন, তাঁরা হলেন, হযরত আলী (রাদ্বি.), হযরত ফাতেমা (রাদ্বি.) এবং তাদের দুই সন্তান হযরত হাসান (রাদ্বি.) ও হযরত হুসাইন (রাদ্বি.)। (তাফসীরে কাবীর)। এ আয়াতের মাধ্যমে আহলে বাইতকে মুহাব্বত করা ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়েছে। ঐ আহলে বাইতের মধ্যে সৈয়্যদা খাতুনে জান্নাত (রাদ্বি.) এর মুহাব্বত অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে খাতুনে জান্নাত (রাদ্বি.) কে মুহাব্বত করা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করা ফরযের অন্তর্ভুক্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রাদ্বি.)’র বর্ণনা, “আমি রাসুলুল্লাহ (দ.)’র সঙ্গে কথাবার্তায় ফাতিমার চেয়ে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকেই দেখিনি। সে যখন তাঁর কাছে আসত তখন তিনি উঠে দাঁড়াতেন, তাকে স্বাগত জানাতেন, চুমো খেতেন এবং নিজের আসনে তাকে বসাতেন। আবার যখন তিনি ফাতিমার কাছে যেতেন তখন সেও তাঁর জন্যে উঠে দাঁড়াত, তাঁর হাত ধরত, তাঁকে স্বাগত জানাত, চুমো খেত এবং নিজের আসনে তাঁকে বসাত। (আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৯৭১)। নবিজি তাকে পৃথিবীর সকল নারীদের শ্রেষ্ঠ গণ্য করেছেন। আনাস (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবি কারিম (দ.) বলেন, “জগতের সব নারী থেকে চারজন নারী অনুকরণের জন্য যথেষ্ট- মরিয়ম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া।” (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৭৮) আখিরাতেও নারীদের শিরোমণি হবেন এ মহীয়সী নারী। নবি কারিম (দ.) বলেন, “ইনি একজন ফেরেশতা ভূপৃষ্ঠে এ রাতের আগে কখনও অবতরণ করেননি, তিনি স্বীয় প্রভুর কাছে অনুমতি চাইলেন যে, আমাকে সালাম দেবেন এবং আমাকে সুসংবাদ দেবেন যে, ফাতিমা জান্নাতের নারীদের সরদার এবং হাসান-হুসাইন জান্নাতের যুবকদের সরদার।” (তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৮১) হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) এর সাথে শত্রুতা কুফরী। হযরত মিসওয়ার ইবনে মখরমা (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত নবি কারিম (দ.) ইরশাদ করেন,“ফাতেমা আমার নূরানী শরীর মুবারকের একটি টুকরা। যে তার সাথে শত্রুতা রাখে, সে আমার সাথে শত্রুতা রাখে।” এ হাদিস দ্বারা ইমাম সুবকী দলীল পেশ করেন যে, যে ব্যক্তি ফাতেমা (রাদ্বি.) এর বদনামী করবে সে কাফের হয়ে যাবে। কারণ সে হুজুর (দ.) এর বদনামী করল আর হুজুর (দ.) এর বদনামী করাটাই কুফরী। (আশিয়াতুল লুমাত ৬৮৫ পৃষ্ঠা, ৪র্থ খন্ড)। হযরত ফাতিমা বতুল (রাদ্বি.)’র উপস্থিতিতে রাসুল (দ.) হযরত আলী (রাদ্বি.) এর জন্য অন্য বিবাহ হারাম ঘোষণা করেন।
অতুলনীয় অনুকরণীয় মা ফাতিমা (রাদ্বি.)
জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি: সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল (রাদিয়াল্লাহু আনহা। মা ফাতিমা (রাদ্বি.)’র চরিত্রের নূর, তাকওয়ার সুবাস যেন চাঁদের আলোয় ধোয়া এক স্নিগ্ধ রজনী, যেন জান্নাতের বাগানের সবচেয়ে পবিত্র ফুল, যেন ঈমানের সমুদ্রের গভীরতম মুক্তো। তার হৃদয়ে ছিল ইখলাসের আলো, কথায় ছিল প্রজ্ঞার মাধুর্য, আর জীবনের প্রতিটি ধাপে ছিল জান্নাতের সুগন্ধি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। তিনি ছিলেন সেই নারী, যার অন্তর কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যাকুল ছিল। তিনি ছিলেন আল্লাহর ওপর নির্ভরতার মহাকাব্য। যখন ক্ষুধার্ত ছিলেন, তখনও অভাবীর মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। যখন ক্লান্ত ছিলেন, তখনও স্বামী-সন্তানের সেবা করেছেন। তাঁর ধৈর্য ছিল এক অটল পর্বতের মতো, যার ওপর ঝড় এলেও চূড়াটি কখনো নত হয় না। তিনি দেখেছেন বাবার রক্তাক্ত মুখ মুবারক, তিনি শুনেছেন মক্কার নিষ্ঠুরদের তাচ্ছিল্যের শব্দ, তিনি কেঁদেছেন উহুদের ময়দানে, তিনি অনুভব করেছেন কষ্টের তীব্র কামড়। তবু তিনি নত হননি, ভেঙে পড়েননি। কারণ তার অন্তরে ছিল এক অবিনশ্বর দীপশিখাÑআল্লাহ তাআ’লার প্রতি অবিচল বিশ্বাস। তাঁর কথায় ছিল নূরের স্পর্শ, তার ভাষণে ছিল ওহির প্রতিচ্ছবি। যখন তিনি খুতবায়ে ফাদাক দিলেন, তখন তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল কুরআনের আয়াত, হৃদয়ে ছিল নবীজির শিক্ষা, এবং যুক্তিতে ছিল এক চমৎকার দীপ্তি। তিনি ছিলেন এক আলেমা, এক ফকিহা, এক দাঈয়াÑযিনি জ্ঞানকে এক মহিমান্বিত উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁর লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর অলংকার। এ এমন এক হায়া, যা জান্নাতের দরজা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। তাঁর পর্দার কী অনন্য শান, বরং তিনি এমন শান ও মর্যাদাবান যে, তাঁর মুবারক সত্তা, তাঁর মুবারক নাম লজ্জা ও পর্দার প্রতীক হয়ে গেছে। বড় বড় ওলামা ও মাশায়িখগণ যখন পর্দার ব্যাপারে দুআ’ করেন, তখন এভাবে আরয করেন: হে আল্লাহ পাক! আমাদের পুত্রবধূ ও কন্যাদেরকে “সায়্যিদা যাহরা” এর পর্দার সদকা নসিব কর। খাদেমে নবি হযরত আনাস (রাদ্বি.) বলেন: একদা রাসুলুল্লাহ (দ.) জিজ্ঞেস করলেন, “মহিলাদের জন্য কোন বিষয়ে কল্যাণ রয়েছে?” সাহাবায়ে কিরাম (রাদ্বি.) বললেন: “আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে, আমরা কি উত্তর দেব।” হযরত আলীয়্যুল মুরতাদ্বা (রাদ্বি.) হযরত ফাতিমা (রাদ্বি.) এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে এ সম্পর্কে বললেন তখন তিনি বললেন: “আপনি রাসুলুল্লাহ (দ.) কে এটি কেন আরয করেননি যে, মহিলাদের জন্য কল্যাণ এতেই যে, তারা (নামুহরিম) পুরুষকে দেখবে না এবং না (নামুহরিম) পুরুষ তাকে দেখবে।” তখন হযরত আলী (রাদ্বি.) প্রিয় নবী (দ.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে এ কথা বললেন, রাসুলুল্লাহ (দ.) জিজ্ঞেস করলেন: “এ কথা তোমাকে কে বলেছে?” আরয করলেন: “ফাতিমা।” তখন রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করলেন: “ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা।”(হিলয়াতুল আউলিয়া)। মুসলমানদের চতুর্থ খলিফা, হযরত মাওলা আলী মুশকিল কুশা (রাদ্বি.) বলেন: “হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (রাদ্বি.) ইন্তিকালের সময় ওসিয়ত করেছিলেন যে, যখন আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিব, তখন আমাকে রাত্রিবেলা দাফন করবেন, যাতে কোন পরপুরুষের দৃষ্টি আমার লাশের উপর না পড়ে।” (মাদারিজুন নবুয়ত, ২/৪৬১)। হযরত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (রহ.) বলেন: মনে রাখবেন যে, (কিয়ামতের দিন) পবিত্র স্ত্রীগণ ও ফাতিমাতুয যাহরা (রাদ্বি.) পর্দা সহকারে উঠবেন, কারণ তাঁরা আল্লাহর বিশেষ আউলিয়ার অন্তর্ভুক্ত। (মিরআতুল মানাজীহ, ৭/৩৬৯)।
রাসুলুল্লাহ (দ.)’র ইন্তিকাল শরীফের ছয় মাস পর ৩ রমযানুল মুবারক ১১ হিজরী সনে মঙ্গলবার রাতে সায়্যিদা, তাহিরা হযরত বিবি ফাতেমাতুয যাহরা ২৮ বছর বয়সে ইন্তিকাল শরীফ হন।জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি: সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল (রাদিয়াল্লাহু আনহা । হযরত সায়্যিদা খাতুনে জান্নাত বিবি ফাতিমাতুয যাহরা (রাদ্বি.)’র জানাযার নামায কে পড়িয়েছেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, একটি বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আলী (রাদ্বি.) ও অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী হযরত আব্বাস (রাদ্বি.) পড়িয়েছেন, পক্ষান্তরে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে, তাঁর জানাযা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বি.) পড়িয়েছেন। ইমামে আহলে সুন্নাত আলা হযরত (রহ.) লিখেছেন: হযরত ফাতেমাতুয যাহরা (রাদ্বি.)’র মাযার সম্পর্কে দু’টি বর্ণনা রয়েছে: (১) বাকী শরীফে (২) একেবারে রাওযায়ে আকদাসের পাশে (প্রিয় নবির (দ.) মাযার শরীফের সাথে)। একজন আশেকে রাসুল মদিনা তায়্যিবার এক আলেম সাহেবকে আরয করলেন: আমি উভয় স্থানে উপস্থিত হয়ে সালাম আরয করেছি, “আনোয়ার” পেয়েছি। তিনি বললেন: এই পবিত্র লোকেরা জায়গার দ্বারা আবদ্ধ নয়, তোমার মনোযোগ থাকা উচিত, অতঃপর নূর বর্ষণ করা তাঁদের কাজ। (ফাতাওয়ায়ে রযবীয়া, ২৬/৪৩২)।
জান্নাতের রমণীদের শিরোমণি: সৈয়্যদা ফাতিমা বিনতে রাসুল (রাদিয়াল্লাহু আনহা। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে মা ফাতিমাতুয যাহরার ফয়েজ-বরকত হাসিল করার তাওফিক্ব নসিব করুন। আমিন। বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া
কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।